
মোগল সাম্রাজ্যের সম্রাট আকবর দিল্লি শাসন করতেন। আর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের তারাব পৌরসভার বাসিন্দা আকবর বাদশা তারাব এলাকা শাসন করেন। এখানের অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণে তিনি গড়ে তুলেছেন কিশোর গ্যাং বাহিনী। হত্যা, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, জমি দখল ও লুটপাটসহ সব ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত এ বাহিনীর সদস্যরা।
আকবর ও তার বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে। মামলায় জামিনে বের হয়ে যাওয়ায় ব্যবস্থা নিতে পারছে না পুলিশ। ভুক্তভোগী অনেকে থানায় আকবর বাহিনীর কর্মকাণ্ড নিয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তবে আকবর বলেছেন, এসব ষড়যন্ত্র ও মিথ্যা অভিযোগ।
থানার পুলিশ, ভুক্তভোগী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারাব পৌরসভার দক্ষিণপাড়া এলাকার বাসিন্দা আকবর বাদশা ২০১২ সালের মে মাসে ফয়সাল আহমেদ নামের এক যুবককে হত্যা করেন। এ ঘটনার মধ্যে দিয়েই অপরাধ জগতে তার উত্থান হয়। এরপর এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে গড়ে তোলেন আকবর বাহিনী। এ দলের সেকেন্ড-ইন কমান্ড শ্রাবণ ওরফে ‘কুত্তা শ্রাবণ’। তার নেতৃত্বে রয়েছে বিশাল কিশোর গ্যাং বাহিনী। চাঁদাবাজি, হত্যা, ছিনতাই, এলাকায় ত্রাস ছড়ানো ও জমি দখল এ বাহিনীর প্রধান কাজ।
তারাব পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ভূঁইয়াপাড়া, তারাব হাঁটিপাড়া, সুলতানবাগ ও দক্ষিণপাড়াসহ আশপাশের এলাকার প্রায় ৪৫ হাজার বাসিন্দা আকবর বাহিনীর কাছে জিম্মি। আকবর বাদশার নেতৃত্বে পৌরসভা এলাকায় গড়ে উঠেছে মাদকের ব্যবসা। এর দেখভাল করেন আকবরের ডান হাতখ্যাত রোবেল ভূঁইয়া (অস্ত্র মামলায় বর্তমানে জেলহাজতে) ও তার স্ত্রী রোকসানা। বাহিনীর আরেক সদস্য মাসুদ ওরফে ‘কুত্তা মাসুদ’ এলাকায় চাঁদাবাজির বিষয়টি দেখভাল করেন। আকবরের তৈরি করা নিজস্ব আদালতও রয়েছে। যারা তাদের কথামতো কাজ করে না, তাদের ধরে এনে সেখানে বিচার করা হয়।
গত বছরের ৩০ জুন দাবিকৃত ৫ লাখ টাকা চাঁদা না দেয়ায় তারাব এলাকার শবনম অয়েল কারখানার সুপারভাইজার লোকমান হোসেন ও ফরিদকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করেন দুর্বৃত্তরা। সে সময় কারখানার ১০ লাখ টাকার মূল্যের মেশিনারি ও অন্যান্য মালামাল লুট করে নিয়ে যান তারা। এ ঘটনায় কারখানার নিরাপত্তা কর্মকর্তা ফেরদৌস মিয়া বাদী হয়ে আকবর বাহিনীর প্রধান আকবর বাদশা এবং শহিদুল, সাইফুল ও মাসুদসহ ১০-১৫ জনকে আসামি করে রূপগঞ্জ থানায় মামলা করেন।
এর আগে ২০২১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে জুয়ার আসরে অভিযান চালায় ডেমরা নৌপুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা। ওই সময় আকবর বাদশার নেতৃত্বে আলামিন, সোহেল, আজমত আলী, আব্দুল মালেক ও আব্দুর রহিম পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও হামলা চালায়। এতে ওই পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক রহমত মিয়া আহত হন। এ ঘটনায় নৌপুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক আরিফুল ইসলাম বাদী হয়ে রূপগঞ্জ থানায় মামলা করেন।
একই বছরের ১ সেপ্টেম্বর চলাচলের রাস্তা দখলকে কেন্দ্র করে আকবর বাদশা, মাসুম রেজা ও আলামিন তালুকদার একটি কেমিক্যাল কারখানার প্রশাসনিক কর্মকর্তা শাহীন মিয়াকে পিটিয়ে আহত করেন। পরে আহত শাহীন মিয়া জানান, আকবর বাহিনীর সদস্যদের অন্য কোনো পেশা নেই। চাঁদাবাজি, হত্যা ও জমি দখলসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডই তাদের মূল পেশা।
এরপর ওই বছরেরই ৫ ডিসেম্বর তারাব দক্ষিণপাড়া এলাকার হিরা মনি, তার মা রাজিয়া বেগম, ভাই রহিম বাদশা ও প্রতিবন্ধী ভাই আব্দুল্লাহকে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে জখম করেন দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনায় হিরা মনি বাদী হয়ে আকবর বাহিনীর রুবেল ও সিয়ামসহ ১৫-২০ জনকে আসামি করে একই থানায় অভিযোগ দায়ের করেন।
সর্বশেষ গত বুধবার আকবর বাহিনী তারাব এলাকায় রাতভর তাণ্ডব চালায়। পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় ১০-১২টি বসতবাড়ি ও বেশ কয়েকটি দোকানপাটে হামলা ও ভাঙচুর চালায় বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
হামলার শিকার মনসুর আলী বলেন, ‘আকবর বাহিনী অহেতুক এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে। কথায় কথায় সাধারণ মানুষকে নির্যাতন করেন। গত বুধবার মদপান করে এ বাহিনীর সদস্যরা আমার বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করেন। এ সময় স্বর্ণালংকারসহ প্রায় ৪ লাখ টাকা লুটপাট করে।’
হামলার শিকার পারুল আক্তার বলেন, ‘আকবর বাহিনী এ এলাকার বাদশা। তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পান না। কোনো কারণ ছাড়াই তারা আমার বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে।’
অভিযোগের বিষয়ে আকবর বাদশার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বলেন, ‘এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। একটি পক্ষ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মামলাগুলো করিয়েছে।’
গত বুধবারের হামলা ও ভাঙচুরের ব্যাপারে আকবর বাদশা বলেন, ‘রাতে ঘটনা ঘটেছে শুনেছি। তবে কে বা কারা করেছে, জানি না।’
রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম সায়েদ বলেন, আকবর বাদশাসহ তার লোকজনের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা রয়েছে। মামলাগুলোতে তারা জামিনে ছিল। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। নতুন করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ মাঠে রয়েছে।
সুত্র দৈনিক বাংলা