A Top Ads
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও ডেমরায় শীতলক্ষ্যা নদীতে নৌপরিবহনে ব্যাপক চাঁদাবাজি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রতিদিন চলাচল করা নৌপরিবহন থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি প্রভাবশালী মহল। এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) সকালে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, শীতলক্ষ্যা নদীর সুলতানা কামাল সেতু থেকে কাঞ্চন সেতু পর্যন্ত নৌপথে মালামাল আনা-নেওয়ার টোল আদায়ের ইজারা নেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাহমুদুল হাসান পলিন। ইজারা নেওয়ার পর থেকে তিনি পেশিশক্তির প্রয়োগে সরকারের নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে তার ইচ্ছামতো টোল আদায় করছেন। এতে নৌযান ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। অভিযোগে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত তার মালিকানাধীন আজমাইন নামে দুটি ফ্লোটিং পাম্প থেকে জোরপূর্বক বেশি দামে তেল নিতে বাধ্য করা হয়। তেল ক্রয় না করলে শারীরিক নির্যাতনসহ এক হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হয় নৌযান শ্রমিক ও মালিকদের। এই পথে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপকর্ম চালাচ্ছেন এই বাহিনীর সদস্যরা।

এর আগে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট শীতলক্ষ্যা নদীর সুলতানা কামাল সেতুর নিচে অবৈধভাবে বিভিন্ন নৌযান থেকে চাঁদা আদায়কালে কাউন্সিলর মাহমুদুল হাসান পলিনের সহযোগী হিসেবে পরিচিত মেহেদি হাসান, আলমগীর হোসেন, আনোয়ার হোসেন, মুমিন মিয়া, আক্তার হোসেন, কাউসার হোসেন, রানা মিয়া, জহিরুল ইসলাম নামে আট চাঁদাবাজকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব-১১। এ সময় তাদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির এক লাখ ৮৫ হাজার টাকা ও চাঁদাবাজিতে ব্যবহৃত দুটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা জব্দ করে র‍্যাব।নৌযান মালিক ও শ্রমিকরা অভিযোগ করে জানান, ওই কাউন্সিলরের ম্যানেজার শাহিন মিয়া, ক্যাশিয়ার রেজোয়ান ও সহযোগী সুমন মিয়াসহ ২০-২৫ জনের দল সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শীতলক্ষ্যা নদীতে অবস্থান নেয়। সারুলিয়া বালুর ঘাট ও সুলতানা কামাল সেতুর পশ্চিম পাশে তাদের কার্যালয় থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা দিয়ে মালামালভর্তি বাল্কহেড, ট্রলার, কার্গো থেকে তিন হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা উত্তোলন করেন। অথচ  বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের ইজারাসূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, শীতলক্ষ্যা নদীর উভয় তীরে ল্যান্ডিং পয়েন্টে মালামাল ওঠা-নামার সময় ধার্যকৃত শুল্ক দিতে হবে। কিন্তু তারা ইজারার শর্ত না মেনে নদীর মাঝপথে নৌযান থামিয়ে তাদের ইচ্ছামতো চাঁদা আদায় করে থাকেন।

সরেজমিনে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শীতলক্ষ্যা নদীর বালুর ঘাট ও সুলতানা কামাল সেতুর নিচে গিয়ে দেখা যায়, ১০-১২ জনের একটি দল বসে আছে তাদের কার্যালয়ে। নদীর মাঝে কিংবা পাশ দিয়ে মালামালভর্তি নৌযান চলাচল করতে দেখলেই ইঞ্জিনচালিত নৌযান নিয়ে ওটাকে থামানো হচ্ছে।

বিআইডাব্লিউটিএ’র নারায়ণগঞ্জের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, এসব ঘাটে নৌকা ভেড়ানো হলে বার্জিং চার্জ ও মালপত্র ওঠানো-নামানোর চার্জ দিতে হবে। কিন্তু নদী দিয়ে ভাসমান চলন্ত নৌকা, বাল্কহেড, কার্গো বা ট্রলারকে টোল দিতে হবে না কোথাও। কেউ বিআইডাব্লিউটিএ’র নামে কোনো ঘাটে টোল আদায় করলে সেটি বেআইনি।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাঁচটি বাল্কহেডের মালিক জানান, সরকারি ইজারার চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ হারে চাঁদা তোলা হয়। শুধু সারুলিয়া বালুঘাট, সুলতানা কামাল সেতুর নিচের ঘাট সীমান্ত থেকে কমপক্ষে দুই থেকে তিন শ ছোট-বড় বাল্কহেডসহ অন্যান্য নৌযান চলাচল করে। বার্জিং বা লোড-আনলোডের টাকা দেওয়ার পরও চলন্ত পথে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। তিনি বলেন, একটি নির্দিষ্ট তেলের পাম্প থেকে প্রতিদিন ৬০০ লিটার তেল নিতে বাধ্য করা হয়। তা-ও আবার ১০০ লিটার তেল কিনলে ওই পাম্প থেকে ৯০ লিটার পাওয়া যায়। এতে প্রতি জাহাজ থেকে আট থেকে ১০ হাজার টাকা তেলবাবদ বেশি টাকা আদায় করা হয়।

মদিনা বাল্কহেডের মালিক আব্দুল করিম জানান, আমরা সারা দেশে নৌযান ব্যবসা করে আসছি। দেশের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত পর্যন্ত দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা শুল্ক দিয়ে এলেও ডেমরা ও বালুঘাট এলাকায় এলে তাদের প্রতিটি ছোট বাল্কহেড ও কার্গো থেকে তিন হাজার, মাঝারি বাল্কহেড ও কার্গো থেকে আট হাজার এবং বড় বাল্কহেড ও কার্গো থেকে ১৫ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়। এ বিষয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করার পরেও কোনো সুরাহা পাইনি আমরা।

খোকন মিয়া নামে এক কার্গো মালিক জানান, তিন বছর ধরে ইজারা বন্ধ থাকলেও একটি রিট পিটিশন দায়ের করে ইজারার সব কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে।

আল আকসা বাল্কহেডের মালিক আফজাল হোসেন জানান, তাদের নির্ধারিত হারের চাঁদা মুখ বুঝে দিয়ে দিতে হয়। তা না হলে আমাদেরকে বিভিন্নভাবে হয়রানিসহ শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়।

নূরে জান্নাত বাল্কহেডের মালিক খোকন মিয়া জানান, গাজীপুরের কালীগঞ্জ ও ঘোড়াশাল এলাকায় আমাদের নৌযানের মাল লোড করা হলেও তারা জোরপূর্বক ডেমরা এলাকার শীতলক্ষ্যা নদীর মাঝপথে আটকে রেখে চাঁদা আদায় করে থাকেন। আমরা তাদের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাই না। প্রতিবাদ করলে প্রাণে মেরে ফেলা ও লাশ গুমের ভয় দেখায়।

আল মদিনা বাল্কহেডের সুকানি আরিফ হোসেন জানান, আমরা নদীপথে চলাচল করার সময় আমাদেরকে জিম্মি করে চাঁদা আদায় করা হয়। যদি তাদের নির্ধারিত পরিমাণ চাঁদা দিতে অস্বীকার করি তাহলে আমাদেরকে মারধরসহ নৌযান আটকিয়ে রাখা হয়।

শাহী মদিনা জাহাজের লস্কর জোটন মিয়া জানান, গত ছয় মাসে কমপক্ষে ২৫ জন সুকানি ও লস্কর এবং শ্রমিককে পিটিয়ে আহত করেছে চাঁদাবাজরা। তা ছাড়া এরা বিআইডাব্লিউটিএ-কে ‘ম্যানেজ’ করেই এমন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৬৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহমুদুল হাসান পলিন তার বিরুদ্ধে ওঠা সকল অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, আমি সারুলিয়া বালুর ঘাট থেকে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত ইজারা নিয়েছি। ইজারার সকল শর্ত মেনেই কার্যক্রম পরিচালনা করছি।

নারায়ণগঞ্জ বিআইডাব্লিউটিআইয়ের যুগ্ম পরিচালক মাসুদ করিম কালের কণ্ঠকে জনান, এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে আমাদের কোনো কর্মকর্তা চাঁদাবাজির সাথে জড়িত নন। চাঁদাবাজির বিষয়ে  নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ দায়েরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি এখনো জানতে পারিনি।

কাঁচপুর নৌফাঁড়ির অফিসার ইনচার্জ মনিরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে জানান, ইতিমধ্যে ইজারার শর্ত অমান্য করে অতিরিক্ত হারে শুল্ক নেওয়ার অভিযোগে কয়েকজন চাঁদাবাজের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।

র‍্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীন মাহমুদ পাশা কালের কণ্ঠকে জানান, সুলতানা কামাল সেতু এলাকার শীতলক্ষ্যা নদী থেকে বিভিন্ন নৌযানে চাঁদা আদায়কালের হাতেনাতে ৮ জন চাঁদাবাজকে গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ফের কেউ শুল্কের অতিরিক্ত হারে চাঁদা তুললে তাদের চিহ্নিত করে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
সুত্রঃ কালের কন্ঠ

আগের সংবাদ দেখুনমুক্তিপন নিতে গিয়ে স্বামী-স্ত্রী গ্রেপ্তার
পরের সংবাদ দেখুনজ্ঞানের আলো আইডিয়াল স্কুলে অবৈধ ভর্তি বাণিজ্য