
নারায়ণগঞ্জ ক্রাইম নিউজ: ট্টাকের লেবার থেকে শুরু করেন কর্মজীবন। ইট উঠানামার কাজ করতেন তিনি। তারপর চিটাগাংরোড পুরাতন বিদ্যুৎ অফিস সংলগ্ন আখের ব্যবসা শুরু করেন। দশ জনের কাছে হাত পেতে সহযোগীতা নিয়ে টাকা উঠিয়ে একটি ছোট্ট টিনের ঘর নির্মাণ করে শুরু করেন চুনা পাথরের ব্যবসা। বলছি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের আটি ওয়াবদা কলোনী এলাকার বাসিন্দা লেবার থেকে শতকোটি টাকার মালিক হওয়া আব্দুল হাইয়ের কথা। বিএনপির আমলে বিএনপি ও আওয়ামীলীগের আমলে আওয়ামীলীগের একজন সক্রিয় কর্মী বনে যাওয়া আব্দুল হাই সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মেম্বার হিসেবে প্রার্থী হয়ে মাত্র সতের ভোট পেয়ে ফেল করে ফেলু মেম্বার হিসেবে আলোচনায় আসেন তিনি। তারই আদ্যপ্রান্ত তুলে ধারবে নারায়ণগঞ্জ ক্রাইম নিউজ। দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক তদন্ত করলে আব্দুল হাইয়ের সম্পদের রহস্য উন্মোচিত হবে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, ১৯৮৫ সালে ২০ বছর বয়সে ট্রাকের লেবার হিসেবে কর্মজীবনে পা রাখেন আব্দুল হাই। শুরুতে ট্টাকে ইট-পাথর লোড আনলোডের কাজ করতেন তিনি। ১৯৯৫ সালে চিটাগাংরোড চাষাড়া রোডের মাথায় পুরাতন বিদ্যুৎ অফিসের সাথে আখের ব্যবসা শুরু করেন। বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলে একটি টিকের ছোট্ট ঘর বানিয়ে শুরু করেন চুনা পাথরের ব্যবসা।
২০০১ সালে জামায়াত বিএনপির আমলে তৎকালিন সংসদ সদস্য আলহাজ্ব গিয়াস উদ্দিনের দয়া ও তার সহযোগীতা নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ বাজার থেকে সারুলিয়া বাজার পর্যন্ত বালুর ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নেন আব্দুল হাই। ২০০৮ সালে ১/১১ এর সেনাবাহিনী আব্দুল হাইকে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে ব্যাপক মারধর করেন। ২০১২ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে চার নাম্বার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সেভেন মার্ডার মামলার ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামী নূর হোসেনের নির্বাচন পরিচালনা করেন আব্দুল হাই। নির্বাচনের পর হাউজিং ফকির বাড়ির জহির উদ্দিন জহুরের কাছ থেকে নূর হোসেনের দাপট তার পেটুয়াবাহিনীর ভয় দেখিয়ে জহুরের কাছ থেকে মেঘনা লাইমস নামে চুনাভাট্টি কেড়ে নেয় আব্দুল হাই।
তারপর থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি ফেলু মেম্বার আব্দুল হাইকে। মেঘনা লাইমস নামে ওই চুনাকারখানার পাশ দিয়ে ডেমরা ইপিজেড গ্যাস লাইনে সংযোগ দিয়ে রাতের আধারে গ্যাস ল্ইানের সংযোগ দিয়ে অবৈধভাবে চুনাকারখানা পরিচালনা করছেন আব্দুল হাই। আবাসিক এলাকায় চুনাভাট্টি পরিচালনা করার দায়ে নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে কয়েকবার সতর্ক করা হলেও কোন কর্নপাতই করছেন না আব্দুল হাই।
গেল ২০১৬ সাল থেকে এই কারখানাটি পরিচালনা করার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে কোন ছাড়পত্র নবায়ণ না পেলেও এক প্রকার গায়ের জোড়ে অবৈধভাবে কারখানাটি পরিচালনা করছেন আব্দুল হাই। এই কারখানাটি পরিচালনা করা জন্য সিটি কর্পোরেশনও ট্রেড লাইসেন্স না দিলেও আব্দুল হাই বেপরোয়া ভাবেই কারখানাটি চালাচ্ছেন। অবৈধ গ্যাস সংযোগের দায়ে কয়েকদফা তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ জরিমানা করলেও কোনভাবেই বন্ধ করেন নি অবৈধ সংযোগ। বরং দাপটের সাথে পরিচালনা করছেন প্রতিষ্ঠানটি।
এক সময়ের সামান্য লেবার আব্দুল হাই সময়ের ব্যবধানে এখন কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। হাইজিং এলাকায় চারকাঠার দুটি প্লট রয়েছে তার যার আনুমানিক মূল্য দুই কোটি টাকা। এছাড়াও তিন কাঠার তিনটি প্লট রয়েছে তার যার আনুমানিক মূল্য তিন কোটি টাকা। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের এক নাম্বার ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনোয়ার ইসলামের বালুর গদি সংলগ্ন দুইটি প্লট দখল করে তিন তলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন যার আনুমানিক মূল্য তিন কোটি টাকা। সানারপাড় বিডিডিএল এলাকায় প্রায় দ্ইু কোটি টাকার জমি কিনেছেন তিনি। ওয়াবদা কলোনী আটি এলাকায় দেড় কাঠা জমির উপর টিনের ঘর নির্মাণ করেছেন। যার আনুমানিক মূল্য দেড় কোটি টাকা।
এছাড়াও পাশের প্লটের মালিকের কাছ থেকে জোড়পূর্বক জমি ক্রয় করে ছয় তলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। যার আনুমানিক মূল্য সাত কোটি টাকা। একটি পাথর বহনকারি জাহাজ রয়েছে আব্দুল হাইয়ের যার আনুমানিক মূল্য দুই কোটি টাকা। আটি এলাকায় দুই কাঠা জমির উপর এক তলা ভবন করেছেন যার আনুমানিক মূল্য চল্লিশ লক্ষ টাকা। এছাড়াও নামে বেনামে প্রচুর জমাজমি রয়েছে আব্দুল হাইয়ের। সবমিলিয়ে একসময়ের লেবার আব্দুল হাই এখন শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে এলাকাবাসীরা মনে করেন।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানাগেছে, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজ সেবক মহিউদ্দিন মাহিনের মাথা ফাঁটিয়ে আলোচনায় আসেন আব্দুল হাই। ওই সময় তৎকালীন সংসদ সদস্য গিয়াস উদ্দিনের ক্ষমতার জোড়ে মামলা থেকেও বেঁচে যান তিনি। এরপর থেকে গিয়াস উদ্দিনের বিশ^স্ত হাতিার হয়ে কাজ করেন তিনি। হাউজিং এলাকায় জমা-জমির ব্যবসা, রড সিমেন্টের ব্যবসা থেকে শুরু করে সকল কিছুই আব্দুল হাইয়ের নিয়ন্ত্রণ করতেন আব্দুল হাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াপদা আটি এলাকার এক বাসিন্দা নারায়ণগঞ্জ ক্রাইম নিউজকে জানান, সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদে মেম্বার পদে আব্দুল হাই নির্বাচন করে ভোট পেয়েছিলেন মাত্র সতেরটি। সেই থেকে তাকে সবাই ফেলু মেম্বার বলতো। এবং মেম্বার হিসেবে তার নাম বলা শুরু করে এলাকার বাসিন্দা। এছাড়াও বিএনপির আমলে তৎকালিন সংসদ সদস্য গিয়াস উদ্দিনের আশি^র্বাদে আব্দুল হাই শীতলক্ষা নদীর সিদ্ধিরগঞ্জ বাজার থেকে সারুলিয়া পর্যন্ত একক নিয়ন্ত্রণ করে অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
আমিরুল আমিন নামে হাউজিং এলাকার এক বাসিন্দা জানান, জহুর উদ্দিনের চুনাভাট্টি নূর হোসেনের ক্ষমতা দেখিয়ে দখল করে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে আব্দুল হাই কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। কারখানাটি হারানোর শোকে জহুর উদ্দিন মৃত্যু বরণ করলে ওই এলাকায় সাধারণ মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের এক সদস্য জানান, এক সময়ের বিএনপি নেতা গিয়াস উদ্দিনের প্রধান সহযোগী আব্দুল হাই এখন আওয়ামীলীগের বড় নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে এলাকায় বহাল তবিয়তে বিভিন্ন অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। অবৈধ চুনাভাট্টি, জমি দখল থেকে শুরু করে এমন কোন কাজ নেই তিনি করেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুল হাই নারায়ণগঞ্জ ক্রাইম নিউজকে জানান, আমি অবৈধভাবে কোন সম্পদ অর্জন করিনি। ব্যবসা পরিচালনা করে বৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেছি।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি মজিবুর রহমান (বিএসসি) নারায়ণগঞ্জ ক্রাইম নিউজকে জানান, আব্দুল হাই নামে কোন ব্যক্তি আওয়ামীলীগ ও অঙ্গ সংগঠনের কোন কমিটিতে তার নাম নেই। দলের নাম ভাঙ্গিয়ে কেউ অপকর্ম করলে তাকে কোনভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না।
তিতাস গ্যাস এন্ড ট্রান্সমিশন কো¤পানী লিমিটেডের নারায়ণগঞ্জ শাখার ডেপুটি জেনারেল ম্যানাজার মামুনুর রশিদ নারায়ণগঞ্জ ক্রাইম নিউজকে জানান, সিদ্ধিরগঞ্জের মেঘনা লাইমস নামে একটি চুনাভাট্টির মালিক আব্দুল হাইকে অবৈধ গ্যাস সংযোগ ব্যবহারের কারণে কয়েকবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন নারায়ণগঞ্জ ক্রাইম নিউজকে জানান, আবাসিক এলাকায় কোন চুনাভাট্টিকেই পরিবেশের ছাড়পত্র নবায়ণ দেওয়া হচ্ছে না। এসকল চুনাভাট্টিগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের বারবার চিঠি দেওয়া হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ দূর্নীতি দমন কমিশন দুদক কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জ ক্রাইম নিউজকে জানান, আব্দুল হাইয়ের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। সে যদি অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করে থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক নারায়ণগঞ্জ ক্রাইম নিউজকে বলেন, কয়েক বছরের ব্যবধানে একজন চুনাব্যবসায়ী কিভাবে কোটিপতি বনে গেছেন তা খতিয়ে দেখে তার বিরুদ্দে আইনী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ান র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লে:কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা নারায়ণগঞ্জ ক্রাইম নিউজকে জানান, অবৈধভাবে গ্যাস চুরি করে কেউ যদি অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।