
নারায়ণগঞ্জ ক্রাইম নিউজঃ এক সময়ে এলাকায় চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি যার পেশা ছিলো সেই লোকটি এখন টাকার কুমির হয়েছেন। অপকর্ম করে এলাকা থেকে জুতাপেটা করে বের করে দেয় এলাকাবাসীরা। পরে রসূলবাগ এলাকায় এসে মামাতো ভাইয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। যার কাছে রিক্সা ভাড়ার টাকাও ছিলো না এক সময়। তিনি গেল বারো বছরে হয়েছেন শতকোটি টাকার ধনকুবের মালিক। কিভাবে এই কালো টাকার মালিক হয়েছেন তা নিয়ে রহস্যের ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে এলাকাজুড়ে। বিশেষ কোন পেশা না থাকলেও তিনি কিভাবে অবৈধভাবে এত টাকার মালিক বনে গেছেন এ নিয়ে চলছে এলাকাবাসীর মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
অনুসন্ধান চালিয়ে জানাযায়, শেরপুর জেলার নকলা থানার এক নং গনপদ্দি ইউনিয়নের খারজান গ্রামের বাসিন্দা সামসুদ্দিন মিয়ার চার ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে আব্দুর রাজ্জাক সবার বড় সন্তান। সামসুদ্দিন মিয়া কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হিমসিম খেতেন। সে সময়ে বখাটে আব্দুর রাজ্জাক অভাবের তারনায় এলাকায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই করে বেড়াতো।
এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে গিয়ে সে সময় নিরীহ পশুকেও গুলি করে এলাকায় আতংক সৃষ্টি করতেন। এলাকাবাসীরা তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ ও প্রথম স্ত্রীকে ভরণ পোষন দিতে না পারায় বিচার শালীশের মাধ্যমে তাকে জুতা পেটা করেন। তারপর থেকে রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছাড়েন তিনি। পরে রাজধানীর মান্ডা এলাকায় এসে লজিং মাস্টার হিসেবে বসবাস শুরু করেন। ওই এলাকার এক ছাত্রীকে পটিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। ২০১৩ সালে সিদ্ধিরগঞ্জের রসূলবাগ এলাকায় আদিল মিয়া নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে মাত্র দুই হাজার টাকা বাসা ভাড়া নেন। তারপর থেকেই পিছনে ফিরতে হননি আব্দুর রাজ্জাক মিয়াকে।
সরেজমিনে রসূলবাগ এলাকায় গিয়ে এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানাযায়, রসুলবাগ দশতলা বাড়িতে ষোলটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার যার আনুমানিক মূল্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। বাড়িটির দক্ষিন পার্শে^ ছয়কাঠা জমি রয়েছে তার যার আনুমানিক মূল্য দুই কোটি চল্লিশ লাখ টাকা। বাড়িটির উত্তর পার্শ্বে পাঁচ শতাংশ জমি রয়েছে যার আনুমানিক মূল্য এক কোটি বিশ লাখ টাকা। পাশেই আড়াইকাঠার উপর ছয়তলা ভবন রয়েছে তার যার আনুমানিক মূল্য তিন কোটি টাকা। এছাড়াও ওই এলাকার ইকবাল মিয়ার কাছ থেকে টিনশেট ভবনসহ তিন কাঠা জমি ক্রয় করেন তিনি যার আনুমানিক মূল্য এক কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা।
উত্তর রসূলবাগ অনিক্স কোম্পানীর পাশে পাঁচ কাঠা জমি রয়েছে তার যার আনুমানিক মূল্য দুই কোটি টাকা, মুক্তি নগর এলাকায় মহিউদ্দিন মেম্বারের কাছ থেকে পাঁচ কাঠা জমি টিনশেট ভবনসহ ক্রয় করেন তিনি যার আনুমানিক মূল্য সাড়ে তিন কোটি টাকা। সিদ্ধিরগঞ্জ হাউজিং এলাকায় পাঁচ কাঠা জমির উপর টিনশেট ভবন রয়েছে তার যার আনুমানিক মূল্য তিন কোটি টাকা। মিজমিজি এলাকায় দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার যার আনুমানিক মূল্য এক কোটি টাকা। নারায়ণগঞ্জ পুলিশ লাইন এলাকায় বিশ কাঠা জমি রয়েছে তার যার আনুমানিক মূল্য প্রায় দশ কোটি টাকা। রাজধানী ঢাকার বনশ্রীতে দুটি বাড়ি রয়েছে তার যার আনুমানিক মূল্য প্রায় দশ কোটি টাকা। এ ছাড়াও নামে বেনামে অঢেল সম্পদ করেছেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রসূলবাগ এলাকার কয়েকজন নারায়ণগঞ্জ ক্রাইম নিউজকে জানান, আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় কাউন্সিলর শাহজালাল বাদলের নাম ভাঙ্গিয়ে রসূলবাগ এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন আব্দুর রাজ্জাক। উত্তর রসূলবাগ এলাকায় মসজিদের সাধারণ সম্পাদক পদটি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বাগিয়ে নেন তিনি।
পরবর্তীতে মুসল্লিদের সাথে খারাপ আচরণের কারণে তোপের মুখে এই পদটি ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। গেল বছর তার মালিকানাধীন ছয় তলা ভবনের অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে অভিযান পরিচালনা করেন তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তারা। এ সময় আব্দুর রাজ্জাক ক্ষিপ্ত হয়ে তিতাস গ্যাসের দুই কর্মকর্তাকে পিটিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করেন। এ বিষয়ে আব্দুর রাজ্জাককে আসামী করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। পরে মোটা অংকের টাকায় রফাদফায় এই মামলা থেকে অব্যহতি পান তিনি।
রসূলবাগ এলাকার বাসিন্দা জানান, এক সময়ে যিনি গাড়ি ভাড়ার টাকা অন্যের কাছ থেকে ধার নিয়ে চলতে হতো, কয়েক বছরের ব্যবধানে সে আজ সমাজের বিত্তশালী হিসিবে পরিচিতি লাভ করেছেন। তিনি কি পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন এটাই কেউ জানেন না। সে কখনো নিজেকে আইনজীবী আবার কখনো রাজনীতিবিদ, কখনো মন্ত্রী ও সচিবদের পরিচয় দিয়ে পুরো এলাকায় দাবিয়ে বেড়াচ্ছেন। গত পাঁচ আগষ্ট সরকার পতনের পর আব্দুর রাজ্জাক রসূলবাগ এলাকা থেকে গাঁ ঢাকা দিলেও এখন সে ওই এলাকায় বিএনপির নেতাদের মোটা অংকের টাকা দিয়ে বসবাস শুরু করেন।
উত্তর রসূলবাগ এলাকার এক বাসিন্দা জানান,’আরে বাবা, রাজ্জাক মিয়া একসময় ভাত খাইতে ভাত পাইত না। মাত্র দুই হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিয়ে চলতে যার হিমসিম খেতে হতো। সে নাহি এহন অনেক বাড়ি-গাড়ির মালিক, গাড়িত কইরা চলে। কিভাবে কী হইলো কিছুই বুঝবার পারলাম না।
মুক্তিনগর এলাকার বাসিন্দা আফসার আলী বলেন, মাত্র দশ বছরে একাধিক বাড়ি, একাধিক জমাজমি ও গাড়ি হাকিয়ে চলাফেরা করছেন রাজ্জাক মিয়া। অথচ তিনি কোন পেশায় চাকরী করেন বা কি করেন কেউ বলতে পারছেন না কিছু। তবে সে একজন তদবিরবাজ হিসেবে এলাকায় পরিচিতি লাভ করেছেন। তিনি দুদকের জালে আটকে পড়া বিভিন্ন অপরাধীদের কাছ থেকে কৌশলে মোটা অংকের টাকা উৎকোচ নিয়ে এসকল সম্পদের মালিক হয়েছেন বলেও পুরো এলাকায় চাউর রয়েছে।
এ বিষয়ে আব্দুর রাজ্জাকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি জীবনে অনেক চড়াই উৎড়াই পার করে, কষ্ট করে সম্পদের মালিক হয়েছি। অবৈধভাবে কোন সম্পদের মালিক হয়নি।
নারায়ণগঞ্জ জেলা দূর্নীতি দমন কমিশন দুদক কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আব্দুর রাজ্জাকের সম্পদের বিষয়ে আমরা অনুসন্ধান চালাচ্ছি। অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা জনান, কয়েক বছরের ব্যবধানে রাজ্জাক মিয়া কিভাবে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পেলে তার অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে।