A Top Ads

নারায়ণগঞ্জ ক্রাইম নিউজঃ টেন্ডারবাজী, জমি দখল, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ, বালু উত্তোলন ও বালু ভরাট থেকে শুরু করে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু। তিনি নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের পর পর তিন বার সংসদ সদস্য ছিলেন। সর্বশেষ জাতীয় সংসদের হুইপও নির্বাচিত হন। সময়ের ব্যবধানে বাবু অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন শতশত কোটি টাকা। তিনি ও তার স্ত্রীর নামে দেশে ও বিদেশে রয়েছে কয়েকশত কোটি টাকার সম্পদ। পিছিনে নেই স্বজনরাও দীর্ঘ ষোল বছরে এমন কোন অপকর্ম নাই যিনি করেন নি। বাবুর কথার বাহিরে টু শব্দও করা যেত না আড়াইহাজারে। তার বাহিনীর ভয়ে তটস্থ থাকতেন সাধারণ মানুষ। পুরো এলাকায় চলতো তার এক দলীয় শাসন। কেউ প্রতিবাদ করলে হামলা, মামলার শিকার হতে হতো ওই ব্যক্তিকে। অনেক নিরীহ মানুষ এলাকা ও ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

বাবুলীগের হুকুমেই সকল কার্যক্রম চলতো। আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরাও সাবেক এই সংসদের হাতে নিরাপদ ছিলেন না। যখন যাকে চাইতেন হাতের পুতুলের মতো নাচাতেন। থানা পুলিশ, প্রশাসন সবকিছুই চলতো তার হাতের ইশারায় গত পাঁচ আগষ্ট ছাত্র জনতার গণ অভূথানে আওয়ামীলীগ সরকার পতন হওয়ার খবরে গা ঢাকা দেন এ প্রভাবশালী সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ নজরুল ইসলাম বাবু। তবে তিনি বিদেশ পালিয়ে গেছেন বলে তার বিশ^ত্বসূত্রে নিশ্চিত করেছেন। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে নজরুল ইসলাম বাবুর বিরুদ্ধে এসব অজানা তথ্য। সাধারণ মানুষ ও ভুক্তভোগীরা বাবু ও তার স্বজনদের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। আড়াইহাজার ঘুরে তাদের সাথে কথা বলে বাবু ও তার পরিবারের সেচ্ছচারিতা জবরদখল ও রামরাজত্বের এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

বালু মহল নিয়ন্ত্রণঃ নজরুল ইসলাম বাবু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর মেঘনা নদী বেষ্টিত এলাকা কালাপাহাড়িয়া এলাকায় মেঘনা নদীতে অবৈধভাবে ড্রেজার বসিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায় করতেন। তার বালু মহলের নিয়ন্ত্রণ করতেন কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম স্বপন, বর্তমান চেয়ারম্যান ফাইজুল হক ডালিম, আওয়ামীলীগ নেতা জয়নাল মিয়াসহ একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট কৃষকদের ফসলি জমির মাটি কেটে অন্যত্র বিক্রি করে দিতেন। ফলে ওই এলাকার কয়েকশত বিঘা জমি নদীগর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। এই বালু মহল থেকে প্রতিদিন পাঁচলাখ টাকা পেতেন সাবেক সাংসদ নজরুল ইসলাম বাবু। ওই এলাকায় বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের পুলিশ কনষ্টেবল রুবেল মাহমুদ, খাগকান্দা নৌ ফাঁড়ির এসআই নাসির সিরাজীসহ দশজন খুন হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসকল ভুক্তভোগী পরিবার কোন বিচার পাননি।

ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ: আড়াইহাজারের পাঁচরুখী এলাকায় ইকোনিমিক জোনে সাত হাজার বিঘা জমি ক্রয়, বিক্রয়, সরকারি জমি দখল, বালু ভরাটসহ অবৈধভাবে কোটি কোিিট টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সাবেক এমপি বাবুর বিরুদ্ধে। অনেক ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে জমি জোড় পূর্বক দখল করে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ইপিজেড এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন সাত গ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগ নেতা অদুদ মাহমুদ ও এই সাংসদের ছোট ভাই দুপ্তারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমুল ইসলাম। বিশনন্দী এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষনা ও প্রশিক্ষন ইনষ্টিটিউট’র সকল কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তিনি নিজেই। তার ছোট বোন জামাই সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামীলীগের নেতা এডভোকেট ফজলে রাব্বি সকল কার্যক্রম দেখভাল করতেন। ইটা,বালু, পাথর থেকে সকল কিছুই দেখভাল করতেন ফজলে রাব্বি।

টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ: আড়াইহাজার উপজেলার সকল টেন্ডারের নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবু। তবে তার বন্ধু হিসেবে পরিচিত মনির ওরফে বোমা মনির ও সরকারি সফর আলী কলেজের সাবেক ভিপি আমির কনষ্টাকশনের মালিক আমির হোসেন ও তার একান্ত ব্যক্তিগত সহকারি অলিউল্লাহ অলি সকল ঠিকাদারির কায্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতেন। আড়াইহাজার উপজেলার ও দুটি পৌরসভার সকল প্রকার ঠিকাদারি কার্যক্রম দেখভাল করতেন তারা।

বিদেশে টাকা পাচার: সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু আড়াইহাজার চৌরাস্তা এলাকায় অবস্থিত ডুবাই প্লাজার মালিক নূর খান ও তার ভাই আওয়ামীলীগ নেতা সোহাগ খানের মাধ্যমে ওখানে প্রচুর টাকা পাচার করে বিশাল সম্পদ গড়ে তোলেন।

ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণঃ সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু আড়াইহাজারের সকল কারখানার মালিকদের জিম্মি করে ফকির গ্রুপসহ সকল কারখানার ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার ছোট ভাই দুপ্তারা ই্উনিয়ণ পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমুল ইসলাম ও বাবুর একান্ত সহকারি(পিএস) অলিউল্লাহ অলি সবকিছু দেখভাল করতেন। ঝুট ব্যবসা থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বাবু ও তার সহযোগীরা।

সরকারি অফিস নিয়ন্ত্রণঃ সরকারি কার্যালয়ে নিয়োগ, বদলীসহ সকল কার্যক্রম পরিচালনা করতেন সাবেক এই সংসদ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ, দুই থেকে পাঁচ লাখ উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ, তিন থেকে পাঁচ লাখ প্রধান শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দশ থেকে পনের লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করতেন তার ব্যক্তিগত সহকারি অলিউর রহমান অলি। এছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যক্রমসহ সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।

চেয়ারম্যান নির্বাচনে মোটা অংকের টাকা আদায়ঃ আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘ সময় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও একক প্রার্থী ঘোষনা করে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এছাড়া দুটি পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলরদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা।

বিএনপি নেতাকর্মীদের উপর হামলা: আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের উপর দীর্ঘ ষোল বছরে হামলা, মামলা দিয়ে এলাকাছাড়া করে রেখেছিলেন সাবেক সাংসদ নজরুল ইসলাম বাবু। শুধু তাই নয় ২০০৯ সালে তিন মার্চ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জুয়েল আহম্মেদকে পিটিয়ে তার দুই পা ও দুই হাত ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া হয়। তিনি মারাত্মক আহত অবস্থায় পঙ্গু হাসপাতালে ছয় মাস ভর্তি থেকে চিকিৎসা নেন। সে সময় তার বাড়িঘরে হামলা ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদের বাড়িতে হামলা ভাংচুর ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন। এসময়ে কয়েকটি গাড়ি ও বাড়িঘরে আগুন দিয়ে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি সাধণ করে বাবু ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী। কেন্দ্রীয় মহিলা দলের সাংগঠনিক সম্পাদক পারভিন আক্তারের বাড়িঘর ও দোকানপাটে একাধিকবার হামলা ও ভাংচুর চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধণ করে। এছাড়াও বিএনপির ও অঙ্গসংগঠনের বহু নেতাকর্মীরা হামলা, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগঃ উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক নিহত তোফাজ্জল হোসেন খাঁনের মালিকানাধীন কৃঞ্ষপুরা এলাকায় দশ কোটি টাকা মূল্যের সাতচল্লিশ শতাংশ জমি জোড় পূর্বক দখল করে কাঁচাবাজার ও মার্কেট নির্মাণ করে দখল করে নিয়েছেন নজরুল ইসলাম বাবু। এই মার্কেটের নাম করণ করা হয় বৌবাজার মার্কেট। নিহত তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে আরিফুল হক খান জুয়েল জানান, আমাদের জমিটি জোড়পূর্বক দখল করে মার্কেট নির্মাণ করে ভাড়া উত্তোলন করেন সাবেক সাংসদ নজরুল ইসলাম বাবু। জমি হারানোর শোকে আমার বাবা ২০২৪ সালের ২৭ মার্চ ও আমার মা আরজুদা বেগম দুই মাস পর মৃত্যু বরণ করেন। আমাকে বারবার হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিলো বাবু ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা।

গাজীপুরা এলাকার মৃত আবুল হোসেনের প্রায় পাঁচ কোটি টাকা মূল্যেল চল্লিশ শতাংশ জমি জোড়পূর্বক দখল করেন তিনি। এই জমির শোকে আবুল হোসেন মৃত্যুবরণ করেন। আবুল হোসেনের ছেলে মামুন মিয়া জানান, আমাদের জমিটি জোড়পূর্বক দখল করে নেয় সাবেক সাংসদ নজরুল ইসলাম বাবু। এই শোক সহ্য করতে না পেরে আমার বাবা অকালে মৃত্যু বরণ করেন। আমি জমিটি ফেরতসহ আমার বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি জানাই। বাজপি এলাকার রহম আলী কন্টেকটার আট কোটি টাকা মূল্যের দুই বিঘা জমি অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে দখল করে নেয়। এ বিষয়ে তার ছেলে জাকির হোসেন বলেন, গত ষোল বছর নজরুল ইসলাম বাবু যেভাবে আড়াইহাজারে রামরাজক্ত চালিয়েছেন এটা কোনভাবেই ভুলবনা আমরা।

অন্যের টাকায় আওয়ামীলীগ কার্যালয় নির্মাণ: আড়াইহাজার উপজেলা আওয়ামীলীগের কার্যালয়টি নির্মাণ করতেও বাবু মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ফকির গ্রুপ নামে একটি কোম্পানীর মালিকের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে এই কার্যালয়টি নির্মাণ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীরা। এই কার্যালয়টি নির্মাণ করতে যতটাকা খরচ করেছেন এর চেয়ে বেশী টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বাবু।

বাবুর হুকুমেই সব হতোঃ বাবুর হুকুম ছাড়া আড়াইহাজারে কোন কার্যক্রমই পরিচালিত হতো না। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে সকল প্রকারের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখল এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। এভাবেই দূর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে রয়েছে তাঁর ধনকুপ। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এই তথ্য। অঢেল সম্পদের পাশাপাশি আড়াইহাজারে আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের কোন নির্দেশই পালন করতেন না তিনি। তিনি যেই আদেশ করতেন সেই আদেশই পালন করতেন নেতাকর্মীরা। তাই আড়াইহাজারে আওয়ামীলীগ না বলে বাবুলীগ বললেই বেশী স্বচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তৃনমুলের কর্মীরা।

একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতিঃ সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু গোপালদী নজরুল ইসলাম বাবু কলেজ,সুলতান সাদি উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজ, জাহানারা বেগম উচ্চ বিদ্যালয়, জাহানারা বেগম ক্যাডেট মাদরাসা, সদাসদি উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তার স্ত্রী ডা: সায়মা আফরোজ ইভা রোকন উদ্দিন গালস স্কুল এন্ড কলেজ, দুপ্তারা সেন্ট্রাল পরোনেশন স্কুল এন্ড কলেজ, গোপালদী মহিলা মাদ্রাসা, গোপালদী গালস স্কুল ও মহিলা মাদ্রাসা, ইউনাইটেড স্কুল এন্ড কলেজের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। শিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী কোন ব্যক্তি একটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে পারবেন কিন্তু নজরুল ইসলাম বাবু কোন নির্দেশই বাস্তবায়ন করেননি বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসীরা।

বাবুর স্বজনপ্রীতিঃ জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ নজরুল ইসলাম বাবু বোনের জামাই আবু তালেব মোল্লা ফতেহ পুর ইউনিয়ন পরিষদের তিন তিনবারের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আবু তালেব মোল্লার বড় ছেলে উপজেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি ইকবাল হোসেন মোল্লা সাব রেজিষ্টার কার্যালয়ে ও ভুমি কার্যালয় নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার ছোট ছেলে ফতেহ পুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি ফয়সাল হোসেন মোল্লা মাটি কাটা,বালু ব্যবসা ও ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনসহ সকল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে ফয়সাল মোল্লাকে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি পদে নির্বাচিত করেন নজরুল ইসলাম বাবু। অনেক পরীক্ষিত ও যোগ্য নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে তার আপন ভাগিনাকে এ পদে বহাল করায় সেই সময়ে সমালোচনার ঝড় উঠে বাবুর বিরুদ্ধে কিন্তু কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি।

সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর ছোট ভাই উপজেলা আওয়ামীলীগের সদস্য ও দুপ্তারা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নাজমুল ইসলাম উপজেলার সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শিল্প কারখানা নিয়ন্ত্রণ করতেন। বাবুর আরেক ভাগিনা হাইজাদি ইউনিয়নের বাসিন্দা রবিন ভুইয়ার দাপটে এলাকায় কেউ মুখ খুলতে সাহস পেতেন না। সাবেক এই সংসদ ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার স্ত্রী ডাঃ সায়েমা আফরোজ ইভাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করান।

বাবুর হাতে আওয়ামীলীগ কর্মীরা নির্যাতিতঃ নজরুল ইসলাম বাবুর রোষানলে পড়ে অনেক ত্যাগী পরীক্ষিত আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীরাও দলীয় সকল কার্যক্রম ছেড়ে নিস্কিয় হয়ে পড়েছেন। সাবেক সাংসদ নজরুল ইসলাম বাবু এক সময়ের সরকারি সফল আলী কলেজের ছাত্রদলের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম সিরাজকে আওয়ামীলীগের ব্যানারে বিশনন্দি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করেন।

অপরদিকে সম্প্রতি আড়াইহাজার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে উপজেলা আওয়ামীলীগের দীর্ঘদিনের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শাহজালাল মিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতিক নিয়ে চেয়ারম্যান পদে পরাজিত হওয়া প্রার্থী সাইফুল ইসলাম স্বপনকে সমর্থন দিয়ে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত করান। এছাড়া গত ষোল বছরে আওয়ামীলীগ সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে তার পছন্দের প্রার্থীদের নির্বাচিত করান তিনি। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে এই সাংসদের বিরুদ্ধে।

দুদকের প্রতিবেদনঃ ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন নজরুল ইসলাম বাবু। তাঁর পর থেকেই বাবুর সম্পদ হু হু করে বাড়তে থাকে। মনে হয় যেন আলাদিনের দৈত্যের চেরাগ হাতে পেয়েছেন। মালয়েশিয়ায় তাঁর বাড়ি-প্লট এবং স্ত্রী সায়মা ইসলাম ইভার নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকার তথ্য পেয়েছে দুদক। ২০১৯ সাল থেকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করে আসছিল দুদক। তাঁর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়ে দুইবার। নানাভাবে তদবির করে তিনি সেই অভিযোগের অনুসন্ধান থামিয়ে দেন। একই বছর দুদক ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে।

এতে নজরুল ইসলাম বাবু ও তাঁর স্ত্রী সায়মা ইসলামের নাম আসে। দুদক এই অভিযোগ অনুসন্ধান করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। অনুসন্ধানে দুদক নজরুল ইসলাম বাবু ও তাঁর পরিবারের বিপুল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পেয়েছে, যা তাঁর বৈধ আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। রাজধানীতে রয়েছে তিনটি ফ্ল্যাট। নজরুল ইসলাম বাবুর রাজধানীর গুলশান-১ এর ১৫ নম্বর রোডের ১ নম্বর প্লটের র‌্যাংগস ওয়াটার ফ্রন্ট ভবনে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। তিন হাজার দুইশত আটত্রিশ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটির দাম আট কোটি টাকা। তবে বাবু তাঁর হিসাব বিবরণীতে এটির দাম দেখিয়েছেন একাশি লাখ টাকা।

এ ছাড়া, সিদ্ধেশ্বরীর মনোয়ারা হাসপাতালের পাশে হাফিজ টাওয়ারে তাঁর একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যেখানে থাকেন তাঁর বোন শিরিনা আক্তার। দুই হাজার একশত সত্তর বর্গফুটের ফ্ল্যাটটির দাম দুই কোটি বাহাত্তর লাখ টাকা। শান্তিনগরের ৮৮ ইস্টার্ন পেয়ার ভবনেও তাঁর একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার দাম অন্তত এক কোটি আশি লাখ টাকা। এ ছাড়া, ঢাকার পূর্বাচলে রাজউকের ১০ কাঠার প্লটের মালিক নজরুল ইসলাম বাবু, যার দাম চার কোটি টাকা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তাঁর কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে বলে জানা যায়। গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সে স্টার ট্রেডিং করপোরেশনে তাঁর বিনিয়োগ রয়েছে পঁচান্নব্বই লাখ টাকা। এছাড়াও নজরুল ইসলাম বাবু ও তাঁর স্ত্রী ঢাকার গ্রীনরোডে সোনারগাঁ ইউনিভার্সিটির ট্টাস্টি। এই ইউনিভার্সিটিতে তাদের শেয়ার ২৫ শতাংশ।

আড়াইহাজার সদরে কৃষ্ণপুরা মৌজায় বাবুর একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে, যার দাম দুই কোটি ৪৫ লাখ টাকা। বাজবী মৌজায় তাঁর আরেকটি ডুপ্লেক্স বাড়ির তথ্য পাওয়া গেছে। এটি তাঁর পৈতৃক বাড়ি। আগের টিনশেড বাড়ি ভেঙে তিনি এটি বানিয়েছেন। আট শতাংশ জমির ওপর নির্মিত এই বাড়ির দাম এক কোটি তিহাত্তর লাখ টাকা। আড়াইহাজারের দুপতারা এলাকায় সূচনা সাইজিং মিলসের মালিক নজরুল ইসলাম বাবু।

এই প্রতিষ্ঠানে তাঁর বিনিয়োগ তিন কোটি টাকা। নরসিংদীর তিনগাঁও মৌজায় বাবুর একশত একচল্লিশ শতাংশ জমি রয়েছে যার দাম দুই কোটি একাশি লাখ টাকা। একই মৌজায় তাঁর দুইশত সতের শতাংশ জমির দাম চার কোটি পনের লাখ টাকা। এখানে তাঁর আরেকটি তেত্রিশ শতাংশ জমি রয়েছে, যার দাম এক কোটি একান্ন লাখ টাকা। মালয়েশিয়ায় ৯৭ চবৎংরধৎধি উঁঃধ উঁঃধ, ঘঁংধহঃধৎধ, ঝৎর ঐধড়ঃধসধং, কঁধষধ খঁসঢ়ঁৎ ঠিকানায় নজরুল ইসলাম বাবুর একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে, যার দাম অন্তত এক কোটি এগার লাখ টাকা। দেশটিতে তাঁর স্ত্রী সায়মা ইসলামের নামে খড়ঃ ২১ ঞধসধহ, চবৎরহফঁংঃৎধরহ, ঘরষধর ঘরষধর-২, ঝবৎবসনধহ, কঁধষধ খঁসঢ়ঁৎ, গধষধুংরধ ঠিকানায় রয়েছে একটি বাণিজ্যিক প্লট, যার দাম অন্তত পঁচানব্বই লাখ তিহাত্তর হাজার টাকা। এ ছাড়া, মালয়েশিয়ায় বাবুর নামে খঙঞ-৭, ২৯+৭.৩০, ঞকঞ ৭, ওগইও চষধুধ, ঔধষধহ উ ওগইও, কঁধষধ খঁসঢ়ঁৎ ঠিকানায় একটি কোম্পানি রয়েছে।

নজরুল ইসলাম বাবু ও তার পরিবারের সদস্যরা চারটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- মেসার্স সূচনা ডায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং, মেসার্স স্টার ট্রেডিং কোম্পানি, মেসার্স বাবু এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স সূচনা ডায়িং প্রিন্টিং ওয়েবিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। বাবুর দুই ভাই, দুই ভগ্নিপতি, ভাগ্নে রাজীব, শাশুড়ি এবং দুই বন্ধুর কাছেও আছে তার বিপুল পরিমাণ সম্পদ। এক ভাই ও এক বন্ধুর নামে পরিচালিত ব্যবসার নেপথ্যেও আছেন তিনি। কেমিক্যাল পণ্য আমদানিকারক ও সরবরাহকারী হিসেবে পরিচিত তারা। আর মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের ৯৭ পার্সিয়ারাও দোতা, দোতা নুসানতারা শ্রী হাউতোমাস এলাকায় একটি ডুপেক্স বাড়ি কিনেছেন বাবু।

বাবুর নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান : ২০০৮ সালে নির্বাচনী হলফনামায় নজরুল ইসলাম বাবু পেশা হিসেবে ‘ঠিকাদার’ উল্লেখ করলেও ২০১৪ ও ২০১৮ সালের হলফনামায় আমদানিকারক ও সরবরাহকারী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। আড়াইহাজার উপজেলা ও কৃষি অফিস থেকে পাওয়া দুটি নথিতে দেখা যায়, মাছ ও ফুল ব্যবসায় বিনিয়োগ আছে বাবুর। তবে বাবুর মাছ কিংবা ফুল ব্যবসা সম্পর্কে কোনো তথ্য জানেন না তার এলাকার কেউ।
দেশে সম্পদের পাহাড় বাবুরঃ ঢাকার গুলশান-১ এ ১৫ নম্বর সড়ক, প্লট নম্বর-১-এ র‌্যাংগস ওয়াটার ফ্রন্টে আছে নজরুল ইসলাম বাবুর চার হাজার দুশো বর্গফুটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাট নং-২সি। ৮৮ শান্তিনগরে ইস্টার্ন পিয়ারে আছে একটি ফ্ল্যাট। রমনা থানার সিদ্ধেশ্বরীর ৬৭, হাফিজ এস্টেটে আছে দুই হাজার একশত সত্তর বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল উপশহরে বাবুর আছে দশ কাঠার কাঠার প্লট। ৬১ বিজয়নগরে ইস্টার্ন আরজু নামে একটি ভবনের মালিক বাবু। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্স-২ এ বাবুর আছে চারটি দোকান (৮/১২, ৮/৪, ৮/৩৪ ও ৮/৩৯)। এ ছাড়া এই শপিং কমপ্লেক্সের আন্ডারগ্রাউন্ডে অবস্থিত চারটি গোডাউনের মালিকও তিনি। গুলশান সিটি করপোরেশন মার্কেটে সাতটি দোকান আছে বাবুর। শান্তিনগরেও বাবুর আছে একটি ভবন। বাড়ি নম্বর ৯০/৯১। শেরেবাংলা নগরের ১৬৩ পূর্ব রাজাবাজারে বাবুর আছে আরও একটি ফ্ল্যাট। বাবুর ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত এক ব্যক্তির নামে কেনা হয়েছে ফ্ল্যাটটি। সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটির পঁচিশ শতাংশ মালিকানা বাবু ও তার স্ত্রীর নামে।

সরেজমিনে আলাপকালে এলাকাবাসীরা জানায়ঃ ৯৯ শতাংশ জায়গা প্রথমে দখলে নেন এমপি বাবু। পরে এক বোনের নামে এই জমি রেজিস্ট্রি করেন। আড়াইহাজার সদরে লোকনাথ ব্রক্ষ্মচারীর আশ্রমের সামনে একটি পুকুর দখলে রেখেছেন তিনি। বাঘানগরের স্থানীয় এক বাসিন্দা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে দশ বিঘা জমি দখলে আছে তার। মুকুন্দী গাজীপুরা এলাকার এক ব্যক্তির ও আত্মীয়স্বজনের আট বিঘা জমির দখলদারও তিনি। কৃষ্ণপুরায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জায়গা দখল করে মায়ের নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন বাবু। কামরাঙ্গীর চর এলাকায় সংখ্যালঘু পরিবারের জমি দখলের পর রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন। গাজীপুরায় স্থানীয় এক বাসিন্দা ও তার পরিবারের সদস্যদের পাঁচ বিঘা জমিও দখলে আছে তার। দীঘিরপাড় এলাকায় চার বিঘা জমি দখলের পর গড়ে তুলেছেন তার নামে বিশাল মার্কেট। ঝাউগাড়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের পাঁচ বিঘা জমি দখলে আছে তার।

বাজবী গ্রামের এক ঠিকাদারের সতের বিঘা জমি দখল করেছেন তিনি। ওই ঠিকাদার এখন এলাকা ছাড়া। এছাড়া রূপগঞ্জের রূপসী মেইন সড়কের পাশে ইনস্টিটিউট অব মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির তিশ শতাংশ শেয়ারের মালিক বাবু ও তার স্ত্রী। বাবুর শাশুড়ির নামে নরসিংদীতে আছে দুশো সাতাত্তর বিঘা জমি। বাবুর অবৈধ আয়ের টাকায় কেনা হয়েছে এসব জমি। গাজীপুরের হোতাপাড়ায় ১৪ বিঘা জমি আছে তার।
এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ নজরুল ইসলাম বাবুর সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায় নি।

নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি গিয়াস উদ্দিন জানান, রাজনীতির নাম ব্যবহার করে আওয়ামীলীগের কতিপয় সংসদ সদস্য দেশের সম্পদ লুটপাট করে দেশের বাইরে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তাদের কোনভাবেই ক্ষমা করবে না এ দেশের মানুষ। তাদের দেশে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করানোর জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

 

আগের সংবাদ দেখুনডিমের বাজারে অভিযান
পরের সংবাদ দেখুনজমি দখল চেষ্টা,বাঁধা দেওয়ায় হামলা