ইসরায়েল ও ইরান বুধবার আবারও একে অপরকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। টানা ষষ্ঠ দিনের মতো তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে তীব্র এ সংঘাত চলছে। এটি পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে গ্রাস করা দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সর্বশেষ পরিস্থিতি নিচে তুলে ধরা হলো :

‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা’ সদর দপ্তরে হামলার দাবি ইসরায়েলের
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বুধবার বলেছেন, বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো ইরানের ‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সদর দপ্তর’ ধ্বংস করে দিয়েছে।

এর আগে সেনাবাহিনী জানায়, তারা তেহরানে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাচ্ছে।

এএফপির সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, ইরানের রাজধানী তেহরানের উত্তর ও পূর্বাংশে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।

কাটজ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো ইরানি শাসনব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সদর দপ্তর—স্বৈরাচারী শাসকের দমনযন্ত্র ধ্বংস করে দিয়েছে।’

একই সঙ্গে তিনি অঙ্গীকার করেন, ‘আমরা শাসনব্যবস্থার প্রতীকগুলোতে হামলা চালাব এবং আয়াতুল্লাহদের শাসনব্যবস্থাকে যেখানেই পাব, সেখানেই আঘাত করব।

ইরানে ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার কথা স্বীকার করল ইসরায়েলে
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বুধবার জানিয়েছে, ইরানে হামলার সময় তাদের একটি ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে। সংঘাত শুরুর পর প্রথমবারের মতো দেশটি ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার কথা স্বীকার করল।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে দেশটির মধ্যাঞ্চলীয় শহর ইসফাহানে ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর একটি সশস্ত্র হার্মেস ড্রোনের ধ্বংসাবশেষের চিত্র প্রকাশ করা হয়েছে।

ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র এফি ডেফরিন বলেন, ‘আমরা ইরানের আকাশে স্বাধীনভাবে বিমান হামলা চালাচ্ছি।

এতে ডজনখানেক বিভিন্ন ধরনের বিমান ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা ইরানের যেখানে প্রয়োজন মনে করব, সেখানেই আঘাত হানব । হ্যাঁ, প্রতিরোধ রয়েছে। কিন্তু আমরা আকাশ নিয়ন্ত্রণে রেখেছি এবং তা বজায় রাখব।’

মার্কিন হস্তক্ষেপে ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ হবে : খামেনির হুঁশিয়ারি
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, তার জাতি ‘কখনো আত্মসমর্পণ করবে না’।

পাশাপাশি তিনি ইসরায়েলের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে বলেন, যদি তারা হস্তক্ষেপ করে তাহলে ‘অপূরণীয় ক্ষতির’ মুখোমুখি হবে।

রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘এই জাতি কখনো আত্মসমর্পণ করবে না। যুক্তরাষ্ট্রকে জানা উচিত, যেকোনো সামরিক হস্তক্ষেপ নিঃসন্দেহে অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনবে।’

এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মঙ্গলবার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র জানে খামেনি কোথায় আছেন, কিন্তু ‘এখনই তাকে হত্যা করা হবে না’।

আরেকটি পোস্টে ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি ইরানের ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ!’ চাইছেন, যা জল্পনা বাড়িয়ে তোলে যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের হামলায় অংশ নেবে কি না। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

সেন্ট্রিফিউজ স্থাপনায় হামলা
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, মঙ্গলবার রাতের হামলায় তেহরানের একটি সেন্ট্রিফিউজ স্থাপনায় আঘাত হানা হয়েছে। সেন্ট্রিফিউজ হলো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি যন্ত্র। এটি সংবেদনশীল প্রক্রিয়ায় পারমাণবিক চুল্লির জন্য জ্বালানি ও দীর্ঘ মেয়াদে পারমাণবিক অস্ত্রের উপাদান তৈরি করতে পারে।

জাতিসংঘের পারমাণবিক নজরদারি সংস্থা পরে জানিয়েছে, তেহরানের পাশের কারাজ এলাকায় দুটি সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদনকেন্দ্র ধ্বংস করা হয়েছে।

নিহতের সংখ্যা বাড়ছে
ইসরায়েলের হামলায় ইরানজুড়ে পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা ছাড়াও আবাসিক এলাকায় আঘাত হানা হয়েছে। ইসরায়েলের আবাসিক এলাকাও হামলার শিকার হয়েছে এবং উভয় দেশ থেকেই বিদেশি সরকারগুলো তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিতে তৎপর হয়েছে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় সোমবার জানায়, শুক্রবার ইরানের পাল্টা হামলা শুরুর পর থেকে ইসরায়েলে অন্তত ২৪ জন নিহত ও শত শত মানুষ আহত হয়েছে।

এ ছাড়া ইরান রবিবার জানায়, ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ২২৪ জন নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছেন সামরিক কমান্ডার, পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও বেসামরিক নাগরিক।

‘নোংরা কাজ’ করছে ইসরায়েল
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিয়ন সাআর বলেছেন, ‘এই যুদ্ধের লক্ষ্য সরকার পরিবর্তন নয়, এটি একটি সম্ভাব্য ফলাফল হতে পারে, তবে উদ্দেশ্য নয়।’

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ সতর্ক করে বলেন, ইরানে সরকার পরিবর্তনের কোনো চেষ্টা ‘অরাজকতা’ ডেকে আনবে।

জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মেৎস মঙ্গলবার এক সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলের অভিযানের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, ‘ইরানের মোল্লা শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ইসরায়েল আমাদের সবার হয়ে এই নোংরা কাজটি করছে।’

ইন্টারনেট সীমিতকরণ
ইরান বুধবার জানিয়েছে, তারা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে আটক করেছে, যাদের বিরুদ্ধে অনলাইনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর এক বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে তাসনিম ও ইসনা বলেছে, ‘এই ভাড়াটে ব্যক্তিরা অনলাইনে পরিকল্পিত কার্যকলাপের মাধ্যমে জনমনে ভীতি সৃষ্টি ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পবিত্র শাসনব্যবস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করছিল।’

ইরান গত সপ্তাহেই ঘোষণা দিয়েছিল, যুদ্ধকালীন সময়ের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারে সাময়িক বিধি-নিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। তার পর থেকে অনেক ওয়েবসাইট ও অ্যাপ আংশিকভাবে সীমিত হয়ে গেছে।

এ ছাড়া কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার জনগণকে আহ্বান জানিয়েছে, যেন তারা ‘ইন্টারনেট সংযুক্ত যন্ত্রপাতির ব্যবহার সীমিত করে এবং অনলাইনে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করে।’

একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে মঙ্গলবার ইরানিদের বলা হয়, তারা যেন নিজেদের ফোন থেকে হোয়াটসঅ্যাপ মুছে দেয়। কেননা এই অ্যাপ ব্যবহারকারীদের অবস্থান ও ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে ‘সেসব তথ্য ইহুদি শত্রুর কাছে পাঠিয়ে দেয়’।

হোয়াটসঅ্যাপের এক মুখপাত্র এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘আমরা উদ্বিগ্ন যে এই মিথ্যা অভিযোগের মাধ্যমে আমাদের সেবাগুলো বন্ধ করার অজুহাত তৈরি করা হচ্ছে, এমন এক সময়ে যখন মানুষ এগুলোর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অনুভব করছে।

সূত্রঃ কালের কন্ঠ